সমানুপাতিক আর ব্যস্তানুপাতিক ছোটোবেলার খুব পরিচিত দুইটি শব্দ, তাইনা? সমানুপতিক নীতি হলো দুইটি রাশির ফলাফল সমান-সমান, অর্থাৎ ডিজিটাল মার্কেটিং পজিটিভ ফলাফল আনলে গ্রোথ হ্যাকিং ও একই পথ অনুসরণ করবে। আর ব্যস্তানুপাতিক হলো; একটি টার্ম পজিটিভ ফল আনলে অপরটি নেগেটিভ ফল আনবে।
যেহেতু আমি টাইটেলেই ভার্সেস শব্দটি উল্লেখ করেছি তাই ডিজিটাল মার্কেটিং ও গ্রোথ হ্যাকিং এই দুইটি টার্মকে ব্যস্তানুপাতিক নীতি অনুসরণ করাটাই উচিত ছিল। নাহ; এখানে একটা কিন্তু আছে; সেটা কি?
একটি বিজনেসে ডিজিটাল মার্কেটিং ও গ্রোথ হ্যাকিং হলো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটি ব্যবসায়ের সেলস ফানেল বা কাস্টমার জার্নির দিকে তাকালেই বোঝা যায় ডিজিটাল মার্কেটার আর গ্রোথ হ্যাকার মডার্ন বিজনেসে একই সেলস ফানেল ব্যবহার করেন, তবে ভিন্ন ভিন্ন ওয়ে তে, তাই এদের ডাকাও হয় ভিন্ন ভিন্ন নামে; যদিও তাদের মেথড বা ফ্রেমওয়ার্ক একই থাকে। তাহলে চলুন দেখে নেয়া যাক কি কি মিল-অমিল রয়েছে এদের মধ্যে।
ডিজিটাল মার্কেটিং
মূলত ট্র্যাডিশনাল মার্কেটিং এর মডার্ন ফর্ম টাই হলো ডিজিটাল মার্কেটিং। ট্র্যাডিশনাল মার্কেটিং এর চ্যানেল গুলো ছিল টেলিভিশন, রেডিও, প্রিন্ট এডস এবং বিলবোর্ড। পূর্বে এই কয়েকটি চ্যানেল এর মাধ্যমেই ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষন করা হতো।
ইন্টারনেট আসার পর থেকে, বিজনেসের উদ্দেশ্য একই আছে, সেই ক্রেতাকে সন্তুষ্ট করা কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে। বিলবোর্ডের পরিবর্তে আমরা এখন দেখি ব্যানার এড। রেডিওর পরিবর্তে প্রমোশনাল অডিও বা ভিডিও মেসেজ। সেলস ফানেলের প্রাথমিক স্টেজ গুলোই ডিজিটাল মার্কেটিং এর মূল টার্গেট।
১ঃ ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে ব্র্যান্ড এওয়ারনেস বৃদ্ধি।
২ঃ কাস্টমারকে এঙ্গেজ রাখা, যা কাস্টমার একুইজিশন নামে পরিচিত।
ডিজিটাল মার্কেটিং রুলস এবং টুলস
এই যুগটাই আলট্রা-কম্পিটিটিভ; কারন প্রতিটি সেক্টরের কোম্পানি গুলোরই এখন আছে ডিজিটাল প্রেজেন্স। এমন পরিস্থিতিতে ডিজিটালি আরো বেশী এক্টিভ হওয়াটা এখন আর অপশন নয় বরং বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে।
সেই সাথে বেড়েছে ডিজিটাল মার্কেটিং প্রোফেশনাল দের ডিমান্ড। বিভিন্ন প্রফেশনাল নিয়ে তৈরী হচ্ছে ডিজিটাল মার্কেটিং টিম। চলুন জেনে নেই ডিজিটাল মার্কেটারদের রোল গুলো কি কি
- ডিজিটাল মার্কেটিং ম্যানেজার
- এস.ই.ও স্পেশিয়ালিস্ট
- এস.ই.এম স্পেশিয়ালিস্ট
- কন্টেন্ট মার্কেটিং স্পেশিয়ালিস্ট
- সোশাল মিডিয়া ম্যানেজার
- ই-মেইল মার্কেটিং স্পেশিয়ালিস্ট
- ডিজিটাল এনালিস্ট
ডিজিটাল মার্কেটিং কোনো ওয়ান-ম্যান অপারেশন না। এর জন্য দরকার স্কিলস এবং সৃজনশীলতার সমন্বয়। কমন ডিজিটাল মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজি গুলো হলোঃ
- অর্গানিক এস.ই.ও
- কন্টেন্ট মার্কেটিং
- ই-মেইল মার্কেটিং
- সোশাল মিডিয়া মার্কেটিং
গ্রোথ হ্যাকিং
অনলাইন চ্যানেল গুলো ব্যবহার করে যেমন ব্র্যান্ড এওয়ারনেস, লিডস বা সেলস বাড়ানো হয়; ঠিক একইভাবে গ্রোথ হ্যাকিং বিজনেস গ্রো এর উদ্দেশ্যেই কাজ করে। আর এখানে পার্থক্য টা হলো গ্রোথ হ্যাকিং সেলস ফানেলের প্রত্যেকটি স্টেজকে বারংবার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে।
গ্রোথ হ্যাকিং মূলত লীন স্টার্ট-আপ ম্যাথডলোজি নিয়ে কাজ করে। যে কোম্পানি গুলো তাদের প্রোডাক্ট একটি মার্কেটে ফিট করবে এ ব্যাপারে ডিটারমাইন্ড ( এই প্রোডাক্টটিই ইন্ডাস্ট্রি তে প্রয়োজন)। তার মানে এখানে অনুমাননির্ভর কাজ খুব কম। কোম্পানিগুলো অলরেডী জানে তারা কাদের কাছে তাদের পন্য বিক্রি করতে চাচ্ছে, আর গ্রোথ হ্যাকাররা তাদের মার্কেটিং এক্সপেরিমেন্টে এই তথ্য গুলোই ব্যবহার করেন।
ডিজিটাল মার্কেটিং যেখানে শুধু মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টেই সীমাবদ্ধ সেখানে গ্রোথ হ্যাকিং শুধু মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টেই নয় বরং প্রতিটি ডিপার্টমেন্টেই যেমন ইঞ্জিানয়ারিং, প্যাকেজিং, সেলস বা কাস্টমার সার্ভিসে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে।
গ্রোথ হ্যাকিং প্রসেস
গ্রোথ হ্যাকার দের একমাত্র লক্ষ্য থাকে একের পর এক নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা ও সেগুলো টেস্ট করা। আর যত দ্রুত সম্ভব ব্যয় কমিয়ে বিশাল গ্রোথ এর দিকে আগানো। রিভিনিউ বাড়ানোর জন্য বিজনেসকে যে ট্রিকস এর আওতায় আনাই প্রয়োজন হোক না কেন তা আনা।
গ্রোথ হ্যাকিং এর পাইরেট ফানেল ছয়টি স্টেজে বিভক্ত একে AARRR framework নামেও ডাকা হয়। আর এই ফানেল কেই গ্রোথ হ্যাকিং এর নীতি হিসেবে অনুসরণ করা হয়। তাহলে চলুন ছয়টি স্টেজের ডিটেইলস গুলো জেনে নেই
- Awareness: কোন ডিজিটাল চ্যানেলের (social media, email, SEO) মাধ্যমে কাস্টমাররা আপনার প্রোডাক্ট খুজে পেয়েছে তা জানা।
- Acquisition: ঠিক কতোজন আপনার ওয়েবসাইট ভিজিট করছে তা নিয়ে জানা।
- Activation: কতো পার্সেন্ট অডিয়েন্স সরাসরি ক্রেতা হচ্ছেন; আর যারা হচ্ছেন না তারা কেন পন্য ক্রয় করছেন না তা জাানা।
- Retention: কতো জান কাস্টমার রিটার্ন কাস্টমার হচ্ছে তা জানা।
- Revenue: নিট আয়ের পরিমাণ নির্ণয়।
- Referral: সাধারন ক্রেতাদের মধ্যে কতোজন প্রোডাক্ট বা সার্ভিসটিকে অন্য সবার কাছে রেকমেন্ড করছে তা জানা।
পাইরেট ফানেলটি ফলো করে একজন গ্রোথ হ্যাকার অডিয়েন্স এঙ্গেজমেন্ট বা সাইন-আপ অনেক বাড়াতে পারেন। এছাড়াও প্রত্যেকটি স্টেজের ডাটা এনালাইজ করে, তথ্য গুলো ফর্মুলেট করার পর কোন সমস্যার সমাধান করেন। কোন সমস্যাকে এটাক করার জন্য গ্রোথ হ্যাকার গণ একটি প্রসেস ব্যবহার করেন, সেটি হলো G.R.O.W.S প্রসেস (Gather; Ideas; Rank Ideas; Outline Experiments; Work-Work-Work; Study Data)
আইডিয়া জড়ো করা: ডিজিটাল দুনিয়ায় আইডিয়া বা ডাটা জড়ো কার তুলনামূলক সহজ। বিজনেস ইন্টেলিজেন্স, ইউজারদের ইন্টারভিউ, বিভিন্ন এনালিটিকস ইত্যাদির মাধ্যমে অনেক তথ্য জড়ো করা যায়।
আইডিয়া র্যাঙ্কিং: প্রথম ধাপে আইডিয়া গুলো কে জড়ো করার পর সেগুলো গুরুত্ব অনুসারে র্যাংক করতে হবে।
আউটলাইন তৈরী: প্রায়োরিটি অনুযায়ী আইডিয়া ঠিক করার পর সেগুলো এক্সপেরিমেন্ট এবং টেস্ট করার জন্য আউটলাইন তৈরী করতে হবে। যেমন টাইম বক্স, কোয়ালিটিভ রেজাল্ট।
ওয়ার্ক: আর এই ধাপটা হলো আসল কাজের সময়। স্কিলড টিমকে সাপ্তাহিক টার্গেট দিয়ে দেয়া এবং তাদের প্রতিদিনের কাজের আপডেট নেয়া হয়।
স্টাডি ডাটা: শেষ ধাপে সহজ থেকে কঠিন ডাটা গুলোকে সিস্টেমাইজ করা হয় এবং পরবর্তী সেশনে এগুলো কে কিভাবে কাজে লাগানো হবে তা প্ল্যান করা হয়।
গ্রোথ হ্যাকিং স্কিলসেট
ডিজিটাল মার্কেটিং স্পেশিয়ালিস্ট দের তুলনায় গ্রোথ হ্যাকার দের আরো বেশী স্কিলসেট এর প্রয়োজন হয়। এটি অনেক প্রসারিত প্রকৃতির বলে গ্রোথ হ্যাকারদের ট্যাকনিকাল এরিয়ায় জানাশোনাটা বিশেষভাবে প্রয়োজন। যেমন:
- ফুল ফানেল এক্সপেরিয়েন্স সহ কাস্টমার জার্নি অপটিমাইজ করতে পারা।
- সি.আর.এম এবং অটোমেশন নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা।
- একুইজিশন চ্যানেল ব্যবহারের দক্ষতা (SEM, email, social media এবং content marketing)।
- ডাটা এনালিটিক্স টুলস নিয়ে ভালো ধারনা।
- কনজিউমার বিহ্যাভিওর সাইকোলোজি বোঝা।
- ওয়েব ডিজাইন টুলস এর ব্যবহার জানা।
তবে বলে রাখি এই স্কিল গুলো ডিজিটাল মার্কেটিং এ দরকার পরে না এমন ভাবাটা ভুল। দরকার পরে; কিন্তু গ্রোথ হ্যাকারদের বেলায় সব এডভান্স বিষয়গুলো জানা থাকতেই হয়।
ডিজিটাল মার্কেটার নাকি গ্রোথ হ্যাকার!
একটি বিজনেসের জন্য আপনি ডিজিটাল মার্কেটার নাকি গ্রোথ হ্যাকার নিয়োগ দিবেন পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করে বিজনেস নিয়ে আপনার টার্গেটের ওপর। আপনার টার্গেট যদি হয় ব্র্যান্ড এওয়ারনেস বাড়ানো, বা বিভিন্ন অনলাইন চ্যানেল থেকে লিড টেনে আনা তাহলে একজন ডিজিটাল মার্কেটার এই কাজটি করার জন্য বেস্ট। তারা সেলস ফানেল কে বিজনেস গ্রোথ এর জন্যই ব্যবহার করে।
অপরদিকে আপনার উদ্দেশ্য যদি হয় কাস্টমার জার্নির প্রতিটি স্টেজকে ভালভাবে এনালাইজ করা, দুর্বল এরিয়া গুলো শনাক্ত করা এবং সেগুলোর সমাধানের মাধ্যমে বিজনেস গ্রোথ করানো তবে আপনাকে একজন গ্রোথ হ্যাকারকেই হায়ার করতে হবে। কারন তারা সম্পূর্ণ কাস্টমার জার্নিকে দক্ষতার মাধ্যমে যাচাই করে এবং বিজনেস গ্রোথ এর সয়ংসম্পূর্ণ সলুশন বের করে।
পরিশেষে
ডিজিটাল মার্কেটিং হলো আপনার বাসের চাকা, যার ফুয়েল ও ইঞ্জিন-পাওয়ার আপনাকে টেনে নিবে স্ট্র্যাটেজিক গ্রোথ এর দিকে। আর গ্রোথ মার্কেটিং স্ট্রেটিজি হলো একটি ম্যাপ; যেটি অনুসরণ করে আপনি নির্ণিত লক্ষ্যের দিকে ছুটে যাবেন। তাই একটিকে রেখে আরেকটি অসম্ভব। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে টিকে থাকতে হলে বাজেট অনুসারে আপনাকে দুই-ই সাথে নিয়ে চলতে হবে। কারন এরা একে অপরের হাত ধরেই চলছে আর চলবে।