দেখা যাচ্ছে, অনেক বড় বড় ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট D-Mart এ অনেক কমে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, ম্যাগি নুডুলস, ক্যাডবেরি চকলেট ইত্যাদি ব্র্যান্ডের প্রোডাক্টস লিস্ট ধরে আপনি অন্য সুপারমার্কেট থেকে D-Mart-এ কমে পাবেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, D-Mart এটা কেন করছে? আর কীভাবেই বা করতে পারছে? তাদের স্ট্র্যাটিজি কী? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হলে আমাদের সাথেই থাকুন।
রিটেইল ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচলিত আছে যে, D-Mart এর এক কিলোমিটার এর মধ্যে যদি আপনার কোনো স্টোর থাকে তবে ব্যবসায় আপনার লসই হবে। কারণ, কোনো কাস্টমারই আসবে না আপনার দোকানে। কিন্তু তারা এটা কেনো বলে?
তা আপনি এটা তাদের মনের ভয় বলেন বা বাস্তবে দেখা ঘটনা, D-Mart তাদের প্রোডাক্টের দাম এতো কম রাখে যে কম্পিটিটররা এটা বলতে বাধ্য। কিন্তু এটি কী করে সম্ভব হচ্ছে? উত্তর লুকিয়ে আছে D-Mart এর ইতিহাসে।
ইতিহাস
D-Mart এর প্রতিষ্ঠাতা রাধাকিষাণ দামানি, যার নাম থেকে D-Mart এর D এসেছে। সাথে ছিল চমৎকার কিছু স্ট্র্যাটিজি, যার মধ্য দিয়ে এই সফলতা এসেছে। ২০০২ সালে তিনি Avenue-supermarket এবং retail chain method ব্যবহার করে D-Mart শুরু করেন।
এর শুরু মহারাষ্ট্রতে মাত্র ২টি স্টোর দিয়ে। বর্তমানে ১১টি স্টেটে এবং একটি ইউনিয়ন টেরিটরিতে এটি ছড়িয়ে আছে। তাদের ২২০টি D-Mart স্টোর এবং ২২৫টি D-Mart রেডি স্টোর রয়েছে।
আপনার মনে হতে পারে, মাত্র এই কয়টি স্টোর দিয়ে কী হতে পারে? কিন্তু, তাদের লাভের পরিমাণ দেখলে আপনি অবাক হবেন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তাদের আয় ছিল ২১১ কোটি রুপি এবং সে সময়ের বড় কোম্পানিগুলো থেকে এগিয়ে ছিল। যেটা ২০২০ এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৩৪৯.৮৯ কোটি রুপি। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে, শুধু প্রোডাক্ট কম দামে বিক্রি করে।
কিন্তু প্রোডাক্ট কম দামে বিক্রি করলে তাহলে লাভ কীভাবে হবে? তাহলে D-Mart কীভাবে এত বড় কোম্পানিতে পরিণত হলো? তাহলে এই লাভগুলো আসছে কোথা থেকে? এর পেছনে রয়েছে D-Mart এর বিশেষ বিজনেস মডেল যেটা রাধাকিষাণ দামানি নিজে বানিয়েছেন।
মোট তিনটি স্ট্রাটিজি রয়েছে।
স্ট্রাটিজি-০১
অল্প খরচে ম্যানেজ করা যাবে এমন স্টোর তৈরি করা।
D-Mart তৈরির আগে, ৯০ দশকের শেষে দামানি অন্যান্য ইনভেস্টারদের সাথে ওয়ালমার্ট ইন্ডিয়ার বিভিন্ন স্টোরে ঘুরে বেড়াতেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল, কাস্টমাররা কোন কোন জিনিস কিনছে, কোন কোন জিনিসের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি; মোটকথা কনজ্যুমার বিহেভিয়ার স্টাডি করার জন্য তিনি মূলত স্টোরগুলো ঘুরে বেড়াতেন। যাতে করে তিনি তার স্ট্র্যাটিজি তৈরি করতে পারেন।
তিনি মূলত ওয়ালমার্টের মালিক স্যাম ওয়ালটনের বিজনেস প্রিন্সিপাল ফলো করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি D-Mart এও খাবার, পোশাক, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস রাখবেন বলে ঠিক করেন।
এতে করে তিন ধরনের লাভ ছিল:
- প্রথমত প্রত্যেকটি প্রোডাক্ট এর চাহিদা সারা বছরই থাকবে, ফলে লাভ হবে এবং খরচ বাঁচবে।
- বড় প্রোডাক্ট না থাকার জন্য বড় স্টোরও লাগবে না অর্থাৎ মেইনটেনেন্স খরচ কমব।
- এতে করে কম স্টাফ লাগবে এবং আবারও অর্থ কম ব্যয় হবে।
আর এই টাকা আবারো স্টোরের জন্য অর্থাৎ বিজনেসে ইনভেস্ট করা যাবে। একই সাথে D-Mart ফল এবং সবজি বিক্রি করে না। এর দুটি সুবিধা আছে।
- যদি প্রোডাক্ট বিক্রি হয় তবে সেটাকে রিফিল করার জন্য ডেডিকেটেড স্টাফ এর প্রয়োজন নেই।
- আর যদি প্রোডাক্ট বিক্রি না হয় তবে টাকা এবং প্রোডাক্ট কোনটারই ক্ষতি হবে না।
এভাবে যে পরিমাণ অর্থ তারা বাঁচায়, তা ডিসকাউন্ট হিসাবে অর্থাৎ কম দামে কাস্টমারদের কাছে সেল করে এবং এতে তাদের সেলিং এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। ফলে লাভ হতে থাকে।
স্ট্র্যাটিজি-০২
নিজেদের দোকান রাখা:
D-Mart এর ৯০% স্টোর তাদের নিজেদের এবং বাকি স্টোর গুলো ৩০ বছরের লিজ বা ইজারাতে রয়েছে। এবং তাদের খরচ হয়েছে ২৩ বিলিয়ন রুপি।
লোকেশন-০১
তারা এমন কিছু জায়গা নির্বাচন করেছে, যে জায়গাগুলোতে সেল ভালো হবে যেমন মেট্রোপলিটন শহর এবং উপশহরগুলোতে। কারণ এসব জায়গাতে জমির দাম কম এবং একই সাথে তাদের টার্গেট কাস্টমারের উপস্থিতিও এখানে বেশি।
লোকেশন-০২
এছাড়া তারা ঐসব নির্দিষ্ট জায়গা গুলোরই পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে আরও কিছু স্টোর ওপেন করে। এর কারণ হচ্ছে যে, কিছু কিছু জায়গায় যদি শুধু একটি দোকান থাকে তাহলে সেখানে অনেক ভিড় থাকে। আর ভিড়ের কারণে হয়তো কিছু মানুষ এখানে যাবে না অথবা গেলে একবারই যাবে।
এতে দুটি সুবিধা আছে।
- ভিড় সামলানোর জন্য অতিরিক্ত স্টাফের প্রয়োজন হবে না।
- ভিড় কম হওয়ার কারণে মানুষ বেশি সময় থাকবে এবং বেশি সময় থাকার কারণে বেশি কেনাকাটা হবে। ফলে লাভও বেশি হবে।
একই সাথে যেহেতু দোকানগুলো তাদের নিজেদের, তাই প্রত্যেক বছর ভাড়া বাড়ার ফলে তাদের অতিরিক্ত পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয় না। ফলে এটি একটি ওয়ান টাইম ইনভেসমেন্টে পরিণত হয় এবং যদি লস হয় তাহলে স্টোর বিক্রি করে দেওয়া যাবে অথবা অন্য একটি ভালো লোকেশনে স্টোর ওপেন করা যাবে। বা সে টাকা বিজনেসেও ব্যবহার করা যাবে।
স্ট্র্যাটিজি-০৩
ডিস্ট্রিবিউটর এবং সাপ্লায়ারদের সাথে D-Mart এর সম্পর্ক
ডিস্ট্রিবিউটর এবং সাপ্লায়ারদের সাথে D-Mart এর একটি ভিন্ন রকমের সম্পর্ক রয়েছে।
এর কারণ দুটি।
- প্রথমত, D-Mart সব ধরনের পেমেন্ট ১০ থেকে ১৫ দিনে করে ফেলে। যেখানে বাকিদের কয়েক মাস লেগে যায়।
- দ্বিতীয়ত, অন্যান্য রিটেইলাররা ডিস্ট্রিবিউটরদের থেকে দুই থেকে তিন মাসের স্টক নেয়। সেখানে D-Mart শুধু এক মাসের স্টক নিয়ে থাকে। ফলে সাপ্লায়ার এবং ডিস্ট্রিবিউটরদের প্রত্যেক মাসে একটি অর্ডার থাকে। কেননা এক মাসেই আগের স্টকটি শেষ হয়ে যায়।
ফলে এটি তাদের মধ্যে একটি মানসিক তৃপ্তি তৈরি করে যার ফলে সময়ের সাথে তাদের এবং D-Mart এর একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এর ফলে D-Mart তাদের কাছ থেকে ভালো পরিমাণে ডিসকাউন্ট এবং কিছু এক্সট্রা প্রোডাক্টও লাভ করতে পারে।
মূলত রাধাকিষাণ দামানি শর্ট টার্মের জায়গায় লং টার্মের লাভের কথা চিন্তা করেছেন। তাই এত কম সময়ে তিনি এত বেশি পরিমাণ লাভ করতে পেরেছেন। তার ইনভেস্টার এবং স্ট্র্যাটিজিক মাইন্ড এবং মার্কেটকে বোঝার ক্ষমতা তাকে এই সফলতা এনে দিয়েছে।
তাছাড়া তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, পৃথিবীতে ধনী মানুষের থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা বেশি এবং তারাই তার টার্গেট কাস্টমার। এবং সেভাবেই তিনি তার বিজনেস মডেল তৈরি করেছেন এবং এগিয়ে গেছেন।