কিভাবে আদানি ধনী? কেন বাড়ছে আদানির সম্পদ?

আদানি বিজনেসম্যান হিসাবে একজন অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তি হয়ে উঠছে। ২০১৯ সালে যে একটি ছোট শহর মুন্ড্রাতে এয়ারপোর্ট অপারেটর ছিল, ২০২২ সালে মাত্র তিন বছরে ভারতের সবচেয়ে বড় এয়ারপোর্ট অপারেটরে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ভারতে হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি শহরের এয়ারপোর্ট এর কাজও তিনি খুব সহজেই পেয়ে যান।

বিতর্ক

তবে এর পিছনে কিছু বিতর্ক আছে। কয়েক বছর আগে ভারতের সর্ববৃহৎ কয়লা ইম্পোর্টের টেন্ডার আদানি পায়। এই ব্যাপারে কিছুটা তদন্ত করার পর জানা যায় যে, বিডিং এর আগেই সরকারি কিছু কর্মকর্তা আদানি গ্রুপকে অন্যান্য বিডারদের এমাউন্ট জানিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে ২০০৬ সালের ৬ লাখ মিলিয়ন টন কয়লার এ বিডিং আদানি গ্রুপ পায়।

বর্তমানের এয়ারপোর্ট এর কাজ পাওয়ার পর কেরালার সিএম Pinarayi Vijayan অভিযোগ তোলেন যে, আদানি গ্রুপের এই সেক্টরে কোন অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার কারণে তারা এই টেন্ডারটি পেয়েছে।  

শুধু তাই নয়, এর মধ্যে Lucknow, Ahmedabad, Mangaluru এই তিনটি শহরের এয়ারপোর্টের মূল্য ছিল ১৩০০ কোটি রুপি। কিন্তু আদানি কিনেছে মাত্র ৫০০ কোটি রুপি দিয়ে।

Mumbai International Airport

আদানির লিস্টে আরেকটি এয়ারপোর্টের নাম ছিল Chhatrapati Shivaji Maharaj International Airport. এটি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ততম একটি এয়ারপোর্ট যেখানে ২৪ ঘণ্টা এক হাজার ফ্লাইট আসা-যাওয়া করে। তাছাড়া এয়ারপোর্ট এর যে অ্যাডিশনাল রেভিনিউ আছে বিভিন্ন দোকান, ফুড কোর্ট, তার টোটাল রেভিনিউ অন্যান্য বড় শপিং মলের থেকেও দ্বিগুণ। এই এয়ারপোর্ট যদি আদানি গ্রুপের অধীনে চলে আসে, তাহলে খুব সহজেই তারা সবচেয়ে বড় অপারেটরের পরিণত হবে। কিন্তু এই কাজটিও অতটা সহজ ছিল না।

মুম্বাই এয়ারপোর্টের স্টক হোল্ডাররা ছিল সব বড় বড় কোম্পানি। অর্ধেকেরও বেশি শেয়ার ছিল GVK কোম্পানির। তারা আদানি গ্রুপের কাছে এয়ারপোর্ট বিক্রি করার বিরোধিতা করেছে। তবে আদানির কাছে এই সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা তৈরি ছিল।

জুন ২০২০ এ, সিবিআইয়ের কাছে একটি বেনামি চিঠি আসে GVK  গ্রুপের ৭০৫ কোটি টাকার স্ক্যাম নিয়ে। যেমন তারা সরকারের কাছে থেকে এয়ারপোর্টের জন্য ৩১০ কোটি রুপি নিলেও, আজ পর্যন্ত কোন কাজই হয়নি। কারণ সব কাজের কন্ট্রাক্ট নকল ছিল। 

এয়ারপোর্ট ফান্ডের থেকে ৩৯৫ কোটি টাকা এই কোম্পানির মালিকেরা নিজেদের কোম্পানিতে ব্যবহার করেছে এবং তাদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক খরচের জন্য। 

মুম্বাই এয়ারপোর্ট এর একাউন্ট বুক মুম্বাইয়ে নয়, বরং হায়দ্রাবাদে তাদের হেডকোয়ার্টারে ছিল। সিবিআই  চেয়ারম্যান কৃষ্ণা রেড্ডি এবং তার ছেলে সঞ্জয় রেড্ডির নামে অভিযোগপত্র দায়ের করে তাদের অফিসে অভিযান চালায়।

যদিও এই বেনামি চিঠি কোথা থেকে এসেছিল, এই ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি।

এর মধ্যে আদানি মুম্বাই এয়ারপোর্ট এর শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে, Airport Company of South Africa Bidewest কোম্পানির শেয়ার ১৫০০ কোটি রুপিতে কিনে নেয়। GVK কোম্পানির এমনিতেই খারাপ অবস্থা ছিল। তাদের উপর ১২ হাজার কোটি রুপির ঋণ ছিল। আদানি তাদের একটি অফার দেয়। অফারটি ছিল যে মুম্বাই এয়ারপোর্টের সব শেয়ারের বিনিময়ে তাদের সব ঋণ আদানি গ্রুপ শোধ করে দিবে। তারা এই অফার মেনে নেয়। 

এবং এভাবেই মুম্বাই এয়ারপোর্টের ৭৪% শেয়ার আদানি গ্রুপের অধীনে চলে আসে। এবং তারা ভারতের সবচেয়ে বড় এয়ারপোর্ট অপারেটর পরিণত হয়। বোনাস হিসাবে Navi মুম্বাই এয়ারপোর্টের কনস্ট্রাকশন এর কন্ট্রাক্টও আদানি গ্রুপ পায়।

সরকারের সাহায্য

তবে আদানির বুদ্ধির সাথে আরও কিছু জিনিস এখানে প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে। এয়ারপোর্ট অপারেশন রাইট পাওয়ার জন্য সরকার পুরনো নিয়মের মধ্যে কিছু পরিবর্তন করে।

  • যাদের অভিজ্ঞতা নেই তারাও অংশ নিতে পারবে এখানে।
  • একটি কোম্পানি একের অধিক এয়ারপোর্টের কাজ করতে পারবে।
  • Lease ৩০ বছর থেকে ৫০ বছরে বাড়ানো হয়।
  • সরকার কোন ধরনের পারসেন্টেইজ শেয়ার চাইবে না। শুধু একটি ফিক্সড ফি প্রতিবছর দিতে হবে।

এর মাধ্যমে বোঝাই যায়, আদানির কন্ট্রাক্ট পাওয়ার পেছনে সরকারেরও হাত রয়েছে। নরেন্দ্র মোদিকে আদানি গ্রুপের এরোপ্লেনে বিভিন্ন জায়গায় যেতে দেখা গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির ২০১৫ সালের মোট ১৮টি বিদেশ যাত্রার মধ্যে ৪টি গৌতম আদানি তার  সফরসঙ্গী ছিলেন। কাকতালীয় হোক বা বাস্তব, গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদি আসার পর থেকে আদানি গ্রুপের স্টক ৭০ গুণ বেড়ে গিয়েছে এবং এখনো বেড়েই চলছে।

Biggest Drug Bust

২০২১ সালে আদানি গ্রুপের Mundra পোর্টে ভারতের সবচেয়ে বড় ড্রাগ সাপ্লাই ধরা পড়ে। ৩০০০ কেজিরও উপরে হিরোইন অর্থাৎ ২১ হাজার কোটিরও বেশি পরিমাণ  মূল্যের ড্রাগ ধরা পড়ে।

তদন্তের পর জানা যায় যে, এই জাহাজটি আফগানিস্তান থেকে এসেছিল এবং পোর্টে পৌঁছানোর আগেই ন্যাশনাল কার্গো ট্র্যাকিং সিস্টেম এর খবর জানায়। তারপরও এটা কীভাবে ভারতে প্রবেশ করলো সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। এবং এত কিছুর পরও আদানিকে কোন ধরনের জবাবদিহিতা করতে হয়নি। যেটা অনেকটা ক্ষমতার অপব্যবহার বলা যায়। 

Mangalore International Airport

ম্যাঙ্গালোর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট আদানি গ্রুপের অধীনে যাওয়ার পর, ত্যাড়া এর Airports Authority of India-এর লোগো সরিয়ে নিজেদের লোগো বসিয়ে দেয়। যেটি পুরোপুরি অবৈধ, এমনকি গুগল ম্যাপেও এই নাম পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে একজন সমাজকর্মী মামলা করলে, লোগো সরিয়ে নেওয়া হয়। 

বিশ্ব অর্থনীতিতে উপস্থিতি

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদানি তার উপস্থিতি জানানোর চেষ্টা করছে। ইসরায়েলের ঐতিহাসিক হাইফা পোর্ট আদানি কিনেছে।

অস্ট্রেলিয়াতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ Thermal Coal Mine সেট করার জন্য কাজ করছে। 

Kosovo, Nigeria এবং South Africa-তে ১৯ হাজার কোটির পাওয়ার প্রজেক্টের কাজ চলছে।

মরক্কোতে অন্যতম বৃহৎ নবায়নযোগ্য এনার্জি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ হচ্ছে। এর ফলে তিনি ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ গ্রিন হাইড্রোজেন সাপ্লাইয়ারে পরিণত হবেন।  

আর এখন এভিয়েশন সেক্টর থেকেও তিনি যথেষ্ট পরিমাণ আয় করবেন। এয়ারপোর্টের বিভিন্ন দোকান ও রেস্টুরেন্ট এবং শপিং সেন্টারের আয় আদানি গ্রুপের কাছে যাবে। তাছাড়া, ভারতের এয়ারপোর্ট রিটেইল পাঁচ গুণ বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং আদানি গ্রুপের আয়ও বাড়বে।

ভারত সরকার এভিয়েশন সেক্টরকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বানানোর চেষ্টা করছে। তাই অল্প কয়েক বছরে এভিয়েশন সেক্টর, আদানি গ্রুপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেভিনিউ জেনারেটরে পরিণত হয়েছে।

নেতিবাচক দিক 

কিন্তু, এখন পর্যন্ত পুরো ঘটনা শুধু বাচক দিকটাই আমরা দেখেছি। এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে।

  • আদানির এই পুরো ব্যবসা আসলে ঋণের উপর ভর করে চলছে। 
  • যেসব ইন্ডাস্ট্রিতে আদানি কাজ করছে, সেসব নিয়ে তার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা বা ধারণাই নেই। 
  • Finance Research Forum Side আদানির ঋণের হিসাব করেছে এবং এটা ২ লাখ কোটিতে। এখন এই বিষয়টি নতুন নয়, অনেক বড় বড় কোম্পানি ঋণের উপর ভর দিয়ে কাজ করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, আদানি গ্রুপের এই ঋণের ঝুঁকি অনেক বেশি। যার জন্য অনেকেই কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে আসলে চিন্তিত। 

এর মধ্যে প্রচুর লোন আদানি পাবলিক সেক্টর ব্যাংক থেকে নিয়েছে। তাই আদানির যদি লস হয় বা তিনি যদি ব্যর্থ হন, তাহলে এটা পুরো ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলবে।  

তবে এটাও দেখতে হবে যে, আদানি নিজেও অনেক বড় একটি ঝুঁকি নিচ্ছেন। তিনি নিজের ব্যবসার পাশাপাশি, দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে অবদান রাখছেন। এতে করে দেশের অর্থনীতিরও পরিবর্তন হচ্ছে, আবার বিশ্ব অর্থনীতিতেও নিজের এবং দেশের পরিচিতি বাড়ছে। 

তাই তার ব্যর্থতাও একইভাবে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলতে পারে। এখন সময়ই বলে দেবে, এর ফলাফল কী হতে পারে। 

Share:

More Posts

Best Uses of LinkedIn Search – Part 1

বিক্রয়কর্মী হিসাবে, আপনার কাজ সম্ভাব্য কাস্টোমার খুঁজে বের করা এবং সেগুলোকে লিড হিসেবে নির্বাচন করা। এক বিলিয়ন সদস্যসহ, লিংকডইন আপনার মাছ ধরার জন্য মাছে ভরা

LinkedIn Marketing

‘বাস্তবে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী আছেন যারা কোল্ড কল ঘৃণা করে এবং তাদের উত্তর দিবেন না। লিঙ্কডইন হল তাদের কাছে পৌঁছানোর চাবিকাঠি।’   সম্প্রতি একটি বৈশ্বিক

কিভাবে লিঙ্কডিন (Linkedin) ব্যাকগ্রাউন্ড/ব্যানার ইমেজ তৈরি করবেন?

সুপারিশকৃত ছবির আকার – ১৫৮৪ x ৩৯৬ আপনার প্রোফাইল ছবির পিছনে আপনার লিঙ্কডইন ব্যাকগ্রাউন্ড / ব্যানার রয়েছে, যা লিঙ্কডইন প্রোফাইলগুলির সর্বাধিক ব্যবহৃত অংশগুলির মধ্যে একটি। 

লিঙ্কডিন (Linkedin) প্রোফাইল ফটো টিপস সম্পর্কে জানতে চান!

আপনার পিছনে একটি সমতল পটভূমি রয়েছে। এটি আপনাকে বিস্তৃত করবে, যেখানে একটি বিশৃঙ্খল পটভূমি আপনার থেকে ভিউয়ারকে বিভ্রান্ত করবে। যদি সম্ভব হয় তবে লিঙ্কডিন ব্যাকগ্রাউন্ডের

Send Us A Message